আরও একটি মেয়ে লুটের খবর এলো এইসময়ে;
মোহিত বেড়াতে গিয়েছিল শেওড়াফুলির এক গাঁয়ে,
ওর সহকর্মী বন্ধু শিশিরের বাবার বাগান বাড়ীতে;
লাঞ্চের পর বেরিয়েছিল মোহিত সিগারেট খেতে;
দূর থেকে শিশিরের বোন ডাকছে, দিতে হ’ল সাড়া।
জিগ্যেস করলো মোহিত, ‘কী হ’য়েছে গো, মন্দিরা?’
রিক্সা দাঁড়িয়ে, সঙ্গে একটা পুলম্যান মন্দিরার;
আদেশ-অনুরোধ, ‘চলো স্টেশনে, সঙ্গে আমার’।
রিক্সায় চাপলো মোহিত; স্টেশনের দিকে একটু যাওয়ার পরে
মন্দিরা বললো, ‘ভালবাসি তোমায়, আমাকে বাঁচাও লুট ক’রে’।
মোহিত বললো, ‘চলো, নিয়ে আসি তোমার বাবা-মার আশীষ’;
মন্দিরা বললো, ‘নেই সময়; লুটবে কোনো বখাটে বদমাইস’।
বললো মোহিত, ‘চলো এবার তাহলে আমাদের বাড়ীতে যাই’।
মন্দিরা বললো, ‘তোমার কাছেই থাকবো, তার আশ্বাস চাই।
আমাকে তোমার কাছ থেকে কেউ নেবেনা তো কেড়ে?
এর চাইতে থাকবো অন্য কোথাও ঘর ভাড়া ক’রে।‘
নিয়ে চললো মন্দিরাকে মোহিত বিনয় বসু রোডে,
উঠলো গিয়ে ওর আমার সঙ্গে দেখা সেই ফ্ল্যাটে;
তখনও খালি ছিল ফ্ল্যাটটা; উঠলো সেখানে মোহিত-মন্দিরা;
১৬-১৭ই জুলাইতে বিয়ে করবে, ঠিক ক’রলো দুজনে ওরা।
********
আমার বিয়ের নির্দ্ধারিত দিনের ঠিক আগের দিন সকালে
১৫ই জুলাইতে লুট হ’য়ে গ্যালো মিলিও বিরাট কোলাহলে;
ওর লুটেরা ছিল সে-সময়ের গৃহমন্ত্রী মুণ্ডা উপজাতির নেতা
বলদেব বাগসুরী; লুটের খবরে ভ’রে গেলো কাগজের পাতা।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে পেয়েছিলাম আমরা খবর মিলির লুটের,
শুধু আমরা নয়, জনসাধারণ সারা দেশের, এমনকি বিদেশের।
আমার-সুভদ্রার, শ্যামল-কেয়ার, মোহিত-মন্দিরার বিয়ে হ’ল নির্দ্ধারিত দিনে;
আনন্দের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল মিলি ও বলদেব - আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে।
শ্যমলদের বাড়ীর সামনের পার্কে এক বিরাট মণ্ডপ রাতারাতি
গড়ে উঠলো গৃহমন্ত্রীর তদারকে; সেখানে জনতার মাতামাতি;
জনতার শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ নিয়ে বিয়ে করলো বলদেব ও মিলি;
গৃহমন্ত্রীর চেষ্টায় হাজির হোলো সেখানে মুসলিম স্বামীর সঙ্গে তুলি।
জানো তো দেশের প্রথম উপজাতীয় প্রধানমন্ত্রী মৃণালিণী বাগসুরী?
সে আমার নিজের প্রিয় দিদি, ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল – মিলি।
********
আমরা সবাই অভিভূত, ঠাকুর্দার গল্প হ’লো শেষ;
‘অর্জ্জুনের রথ থামলো তাহ’লে?’ প্রশ্ন হ’লো পেশ।
‘সুখের দাম্পত্য জীবন হোলো শুরু অর্জ্জুন সুভদ্রার।‘
‘ঠিক তা নয়, ঝিকি। উপায় ছিল না দাঁড়িয়ে থাকার;
ঘটনা-দুর্ঘটনায় হোতে হোলো সম্মুখীন কঠিন পরীক্ষার;
দু-টুকরো ক’রে ভাগ হোল আমাদের সোনার বাংলার;।
এক টুকরো পেলো ভারত আর এক টুকরো পেলো পাকিস্তান।
দাঙ্গা হোলো ভায়ে ভায়ে, পরস্পরের শত্রু হিন্দু আর মুসলমান।
প্রতিবেশী পরস্পরকে আর মেলে নিলো না ভাই-বোন বলে;
‘আমরা দুজন এক গাঁয়েতে থাকি,’ এই সম্প্রীতি গেলো ভুলে।
ভুলে গেলো ‘আমরা বাংলা ভাষায় বলি’, গর্ব্বে বুক ভ’রে ওঠার।
শুরু হোল দাঙ্গার – উন্মাদনা পরস্পরকে করার অকারণ সংহার।
পাড়ায় পাড়ায় জ্বলে উঠলো আগুণ;
ভায়ের সাথে ভায়ের রক্তারক্তি খুন।
আমাদের পাশের বাড়ীতে রাতদিন কাজ করতো এক মুসলমান
যতটা জানতুম, পাড়ার ছেলেমেয়েরা তাকে দিতো শ্রদ্ধা ও সম্মান।
একদিন সকালে দেখা গেল তার মৃতদেহ রাস্তার ধারে পড়ে,
গলা আর বুক থেকে বেরোন লাল রক্তে গেছে ফুটপাথ ভ’রে।
ডানপাশের বাড়ীতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ ক’রতো একটি মুসলমান মেয়ে –
বছর চোদ্দ-পনের তার বয়েস; ইদানীং বাড়ী ফিরছিল না দাঙ্গার ভয়ে।
রান্না ক’রতে ক’রতে হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছিল কিছু মশলা কিনতে,
কি হোলো তার কেউ জানে না, সে পারেনিকো বাড়ীতে ফিরতে।
পাড়ার ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞাসাবাদ ক’রে মেলেনি কোন খবর;
মেয়ে লুট ক’রে বিয়ে তখন হচ্ছিল না, যা হচ্ছিল ধর-পাকড়,
মরদদের খুন ক’রে বাড়ীর মেয়ে বৌকে ক’রছিল অধিকার,
গরুর মতো ক্রীতদাসী নিয়ে ক’রছিল সম্ভোগ ও অত্যাচার ।
হিন্দু মুদিটাকে মুসলমানেরা কাটলো কুপিয়ে কুপিয়ে,
ওর পোয়াতি বৌটাকে হাত-পা বেঁধে গ্যালো তুলে নিয়ে;
গলা ফাটিয়ে চেঁচালো বৌটি কাঁদছিল ককিয়ে ককিয়ে;
উত্তরে খুনীগুলো সব ক’রছিলো উল্লাস আজান দিয়ে।
********
আমাদের বাড়ীতে আমরা তখন পাঁচটি মাত্র প্রাণী –
ষোলোআনা হিন্দু বাবা, মা আর আমি তিনজনই,
সুভদ্রা ষোলোআনা মুসলমানী - আমরা যতদূর জানি,
আর ওর সন্তান, অভিমন্যু? আমি নিশ্চিত মুসলমানই;
তবে খাতায় কলমে ও আমাদের কুলপ্রদীপ, হিন্দু পুরোপুরি,
বাবা-মার ধারণা ও আধাহিন্দু – কারণ ওর মা মুসলমানী।
সুভদ্রা জিতে নিয়েছে বাবা-মা দুজনেরই মন;
ওর অতীত পরিচয় নিয়ে ছিল চিন্তা সারাক্ষণ।
ঠাকুর্দ্দা আবার বলতে শুরু ক’রলেন একটু নিঃশ্বাস নিয়ে,
‘পাকিস্তান থেকে ভারতে এলো অগুন্তি মানুষ উদ্বাস্তু হোয়ে,
‘ভারত থেকেও অনেক অনেক মানুষ পাকিস্তানে গেলো।
তবুও পাকিস্তানের কয়েকটি টুকরো ভারতের মধ্যে রইলো;
পাকিস্তানের মধ্যেও রইলো ভারতবর্ষের টুকরো কয়েকটি।
এই টুকরোগুলোর আর এক নাম এনক্লেভ বা অন্তর্ভুক্তি;
কোনো অন্তর্ভুক্তির ভিতরে রইলো আর এক অন্য অন্তর্ভুক্তি;
এদেশে ওদেশের টুকরোর মধ্যে, এদেশের টুকরো কয়েকটি।
এই অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলি কখনোই হয়ে উঠতে পারেনি স্বয়ংসম্পূর্ণ আত্মনির্ভর।
শাসনব্যবস্থা এবং দ্রব্যপরিবহনের ব্যবস্থা বজায় রাখাও এখানে খুবই কষ্টকর।‘
আবার থামলো ঠাকুর্দ্দা। আমি বললাম, ‘হোলো তোমার গল্প শেষ?
তোমার লুটে আনা মেয়েটিতো এতদিনে ভুলে গেছে তার দেশ।
ভুলে গেছে সে একদিন ছিল এক বোরখা পরা মুসলমানী,
মনে নেই সেই মরদটিকে, যার সে ছিল পেয়ারের ঘরণী।‘
‘ঠিক বলেছিস ঝিকি,’, যোগ দিলেন ঠাকুমা,
‘আমার অতীত ভুলে গেছে অর্জ্জুন-বাবা-মা।
শ্যামলের বাবাকে মেনে নিয়েছি নিজের বাবা ব’লে;
আমি ওর নিজের মেয়ে, যেমন শ্যামল ওঁর ছেলে।‘
ঠাকুর্দ্দা আবার শুরু ক’রলেন, ‘বাড়ীতে তখন সবাই হিন্দু;
বাড়ীর বাইরে হিন্দু-মুসলিমের বিভেদ বেড়েই চললো কিন্তু;
সেখানে চালু রাখতে হোলো আমাকে হিন্দু হ’য়ে লড়াই;
সুভদ্রার কাছে এ নিয়ে কখনো ক’রতে পারিনি বড়াই।‘
১৯৪৭ সালে পেলাম স্বাধীনতা, ইংরেজ শাসনের হোলো শেষ;
ভারতকে কেটে হোলো - ভারত ও পাকিস্তান – নতুন দুটি দেশ।
মুসলিম বসতি বেশী পাকিস্তানে; ভারতে বেশী হিন্দুধর্ম্মের চল;
পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান - পাকিস্তানের দুটি অঞ্চল।
পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস মূলত: এক শোষণের ইতিহাস
পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের হাতে নিগ্রহ আর অবিশ্বাস।
১৯৫৮ থেকে ১৯৭১ অবধি সামরিক শাসন
দুঃসাধ্য হ’য়েছিল সব বাঙালীর জীবনধারণ।
বাংলাদেশ ছিল কেবল পাকিস্তানের একটি কলোনী,
বাংলাদেশীরা ছিল না দেশের নাগরিক বা পাকিস্তানী।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ বেশ প্রাচীন;
১৯৭১ সালে বাংলা দেশ হোলো স্বাধীন। মানব বসতি এখানে হয়তো প্রাগৈতিহাসিক যুগের।
প্রথম শুরু সম্পূর্ণ স্বাধীন ও একতাবদ্ধ রাষ্ট্রের।‘
এর পরে হোলো আন্দোলন শুরু সীমারেখাহীন জগতের;
হয়তো সবাই পড়েছো গল্প অর্জ্জুন চ্যাটার্জীর মেহনতের।
টিভিতে দেখেছো ‘সীমারেখা নেই’ আন্দোলনের এই ঘটনা;
৮ই আগষ্ট ওয়েলিংটন এয়ারপোর্টে, ইতিহাস হোলো রচনা।
দিনের প্রথম ওড়ান সকাল ৬টায়, ফিলাডেলফিয়া যাবার;
ভোর তিনটেয় ঠিক, খুললো ছ-টি চেক-ইন কাউন্টার -
৪টে ইকনমি ক্লাসের আর ২টি বিজনেস-ফার্স্ট ক্লাসের।
ইকনমি ক্লাস আর বিজনেস-ফার্স্ট ২-টি লাইন যাত্রীদের।
৪-জন যাত্রীর ডাক পড়লো ইকনমি ক্লাসের লাইন থেকে;
বিজনেস-ফার্স্ট ক্লাস লাইন থেকে ২-জনকে নিলো ডেকে।
‘অনুগ্রহ করে দেখান টিকিট পাসপোর্ট আপনার।‘, -
একসঙ্গে বললো যেন ৬-টি চেক-ইন কাউন্টার;
৬-জন বিমানসংস্থার কর্মী সহাস্যে ৬-জন যাত্রীর মুখোমুখি;
পাসপোর্ট টিকিট জমা দিল যাত্রীরা একসাথে দেখাদেখি।
ই-টিকিট দেখে হাসিমুখে বললো কর্মী বিমানসংস্থার, -
‘যাচ্ছেন আপনি ফিলাডেলফিয়া শহরে, আমেরিকার’;
পাসপোর্টের ফটোর সংগে মিলিয়ে নিলো যাত্রীর চেহারার;
সব ঠিকঠাক; কিন্তু পাসপোর্টে কোনো হদিশ নেই ভিসার ।
‘এ পাসপোর্টে ভিসা নেই ইউ-এস-এ যাবার;
পুরোনো পাসপোর্টে যদি থাকে, দেখা দরকার‘,–
জিগ্যেস কোরলো ধীরে কর্মী বিমানসংস্থার।
‘আমি পৃথিবীর নাগরিক, নেইকো আমার,
ইউ-এস-এ যাবার ভিসার কোন দরকার‘
– যাত্রীর জবাব এলো, জোরদার পরিষ্কার।
বিমানসংস্থার কর্মী উত্তর দিলো, - ‘না শুভানুধ্যায়ী,
আপনি নিউজিল্যান্ডের নাগরিক পাসপোর্ট অনুযায়ী ।
ভিসা ছাড়া আপনাকে উঠতে দেওয়া যাবে না প্লেনে;
সুটকেশ টাইপের কিছু কি সঙ্গে নেবার আছে মনে?’
উত্তর দিলো যাত্রী, ‘না, এই কেবিন ব্যাগটা সঙ্গে কেবল।‘
এয়ারপোর্ট স্টাফ বললো, ‘ব্যাপারটা হয়তো নয় সরল।
প্লীজ পাশে দাঁড়ান, পরের যাত্রীকে আসতে দিন এগিয়ে;’ –
একথা বলেই বিমানসংস্থার কর্মী দেখলো মুখ ফিরিয়ে
বাকী পাঁচটি চেক-ইন কাউন্টারগুলোর দিকে;
প্রতিধ্বনি শুনলো যেন পাঁচ সহকর্মীর থেকে ।
চেক-ইন করার জন্যে যে-কয়জন যাত্রী হয়েছে হাজির,
তাদের সঙ্গে স্যুটকেশ বা বড় ব্যাগের নেই কোন নজির।
কারুর পাসপোর্টেই নেই ভিসা আমেরিকা যাওয়ার;
পেছনের যাত্রীর জন্যে ইচ্ছে নেই সরে দাঁড়াবার।
যাত্রীদের লাইনের দিকে তাকালো বিমানসংস্থার কর্মীরা –
লাইন যেন বাসে ওঠার জন্যে, দূরে থাক বিমানে চড়া।
প্রত্যেক যাত্রীই দেখিয়েছে টিকিট আর পাসপোর্ট তার,
কিন্তু ভিসা নেই কারুরই সংগে গন্তব্য স্থানের যাবার।
প্রস্তুত ছিলো না এরকম ঘটনার জন্যে কর্মীরা বিমানসংস্থার;
চাইলো বসের নির্দ্দেশ, এখন ওরা কী করবে বাতলে দেওয়ার।
নিরাপত্তা বাহিনীর ডাক পড়লো, গ্রেপ্তার হলো ছয় ভিসাহীন যাত্রীরা,
বোর্ডিং পাশ না নিয়ে নড়তে চায় নি চেক-ইন কাউন্টার থেকে যারা।
ছয়জন যাত্রী গ্রেপ্তার হলো; আরো ছয়জন এগিয়ে এলো;
বিনা ভিসায় বোর্ডিং পাশ চায়; তাই তারা গ্রেপ্তার হোলো।
পরবর্ত্তী ছয়জন যাত্রীরও একই অবস্থা পাসপোর্ট-ভিসার;
একই রকম আচার-আচরণ; হ’লো তাই তারাও গ্রেপ্তার।
হ’তে রইলো এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, সবাই হোলো গ্রেপ্তার,
ভিসাহীন দুশো পনেরোটি যাত্রীর, ছাড়া কেউ পেলোনা আর।
বোর্ডিং পাশ পেলো না - ভিসাহীন সবকটি প্যাসেঞ্জার,
লাগেজ বেল্টে মালপত্র তোলার হোল না দরকার।
ভারী মালপত্র বিমানের খোলে পাঠায় যে বিমানকর্মীরা,
চেকড্-ইন কোনো মাল না পেয়ে চিন্তিত হ’ ল তারা।
চেক-ইন কাউন্টারে তারা এলো চলে,
সেখানের অবস্থা স্বচক্ষে দেখবে ব’লে।
ফ্লাইট-ক্রুএর কাছে অনুরোধ গেলো দেরী করে আসার,
কারণ বিমানে চড়ার জন্যে তৈয়ার নেই কোন প্যাসেঞ্জার;
বিমানবন্দরে আসার আগে তারা যেন করে ফোন;
ফ্লাইট বাতিল হল; সবকটি যাত্রীর হ’লো কারাবরণ।
ওয়েলিংটন বিমানবন্দর থেকে এর পরের উড়ানেরও একই হ’ল দশা;
এই উড়ানেরও সব যাত্রী হাজির হয়েছে না নিয়ে বিদেশে যাবার ভিসা।
তার পরের উড়ানের অবস্থা হ’ল না কিছু আলাদা, না তার পরের কোনো উড়ান,
ওয়েলিংটন বিমানবন্দর থেকে ছাড়লো না সারা দিন কোনো বিদেশগামী বিমান।
অকল্যান্ড, ক্রাইষ্টচার্চ ইত্যাদি নিউজিলান্ডের অন্য বিমানবন্দর
কিছু পরে জানালো সেখানের সব বিদেশে উড়ানের খবর।
৮ই আগষ্টে নিউজিল্যান্ডের কোনো বিমানবন্দর থেকে সারাদিনে,
ছাড়েনি আন্তর্জাতিক উড়ান যাত্রীদের ভিসা না থাকার কারণে।
দাবী করেছে যাত্রীরা, জগৎ নাগরিকের জন্মগত অধিকার
জগতের যে কোনো নগরে যাওয়ার; ভিসার নেই দরকার।
কয়েকঘন্টা পরে একই ঘটনা ঘটলো মেলবোর্ন, সিঙ্গাপুরে,
সিডনী, ব্যাঙ্কক, কুয়ালালামপুর এবং অন্যান্য বিমানবন্দরে ।
নরোত্তম পৃথিবীর প্রতিটি দেশে, পৃথিবীর প্রতি বিমানবন্দরে, বিছিয়েছে জাল তার,
ব্যবস্থা করেছে প্রতিটি আন্তর্জাতিক উড়ানের প্রতিটি সীটের যাত্রীর টিকিট কাটার।
ক্রেডিট কার্ডে, ট্রাভেল ইনসুর্যান্সের সঙ্গে প্রতিটি টিকিট হয়েছে কেনা।
যদি যাত্রী না পায় বোর্ডিং পাশ, এবং নির্দ্ধারিত সময়ে উড়ান ছাড়ে না,
তাহলে ইনসুর্যান্স কোম্পানী দেবে ক্ষতিপূরণ
টিকিট ইস্যু হয়েছে ভিসা ছাড়াই, এটাই কারণ।
পৃথিবীর প্রতি দেশে, নগরে, প্রত্যেক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে
চললো একটানা অহিংস আন্দোলন ভিসার আইন অমান্য ক’রে।
এক দেশ থেকে যাওয়ার নেই আর কোনো দেশ -
সমস্ত আন্তর্জাতিক উড়ান হলো স্থগিত বা শেষ ;
অতর্কিত পূর্ণচ্ছেদ পড়লো শুধু বিমান উড়ানে না;
ইনসিউরান্স কোম্পানী বন্ধ করলো বীমা বেচাকেনা;
বিমাবন্দরের কর্ম্মচারীদের রইলো না কোনো কাজ;
শূণ্য বিমানবন্দরের তহবিল; হঠাৎ নামলো সাঁঝ।
বিমান বন্দরের থাকলো না কোনো আয়;
কর্ম্মচারীদের বেতন দেওয়া হ’ল এক দায়।
দিনের পর দিন হোলো ভিসাহীন যাত্রীদের গ্রেপ্তার;
ভ’রে গেলো কারাগার; ঠাঁই নাই নতুন বন্দী রাখার।
স্থগিত রইল বিমান-চলন, শিল্প আমদানি-রপ্তানী যাবতীয়;
জরুরী মিটিং ডাকল সংযুক্ত জাতি সংস্থা বা ইউ.এন.ও.
কিন্তু ইউ.এন.ও.-এর সভ্যদের নেই উপায়
মিটিং করা গিয়ে কোনো দেশে একজায়গায়।
সমস্ত উড়ানই হয়ে গেছে বাতিল;
স্কাইপ মিটিংএ হ’ল সবাই সামিল।
নেই ইউ.এন.ও.-এর সামনে সমস্যার কোনও সমাধান;
উড়তে দিতেই হবে সমস্ত ভিসা ছাড়া যাত্রীর বিমান;
সবচেয়ে বেশী অসুবিধা তাতে গন্তব্যস্থানের দেশের,
দারুণ আপত্তি আশ্রয় দিতে অবাঞ্ছিত আগন্তুকদের;
ওদিকে বিনা ভিসায় উড়ে যাবার জন্যে উৎসুক লোক সারা দুনিয়ার;
দিনের পর দিন একই যাত্রীরা টিকিট কেটেছে একই গন্তব্যে যাবার।
কী করবে এখন ইউ.এন.ও.? জেরা করা হ’ল প্রতি ভিসা-ছাড়া যাত্রীকে;
নরোত্তম আর অর্জ্জুন - জিজ্ঞাসাবাদের পর দুটি নাম এলো সকলের মুখে।
তাঁরা আদেশ দিলেন নরোত্তমকে গ্রেপ্তার ক’রে জিজ্ঞাসাবাদ করার,
যাতে থামানো যায় সারা পৃথিবীর মানুষের আন্দোলন আইন-ভাঙ্গার।
কিন্তু কী-করে গ্রেপ্তার করা যাবে নরোত্তমকে?
অগুন্তি মানুষের দাবী তারা নরোত্তম প্রত্যেকে।
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ হঠাৎ নরোত্তম হয়ে গেছে যেন।
কোন্ নরোত্তমকে গ্রেপ্তার করবে কোন্ পুলিশ? কেন?
আনা গেল না আয়ত্তের মধ্যে নির্ভিসা পরিস্থিতিকে।
মিললো না আসল নরোত্তমের হদিশ কোনোদিকে।
নিরাপত্তা বাহিনী নিরুপায়, অর্জ্জুন হ’ল গ্রেপ্তার;
তার মস্তিস্ক বিশ্লেষণ ক’রে শুরু যত গবেষণার।
জগতবাসীর বিশ্বপ্রেরণা দেখে মনে হ’ল অর্জ্জুনের
বিশ্বচেতনায় প্রেরণা দিতে প্রয়োজন বিশ্বসঙ্গীতের;
স্বপ্ন দেখলো সারা পৃথিবীর মানুষ কাছে, দূরে -
কন্ঠ মিলিয়েছে একসঙ্গে – গাইছে একসুরে -
Imagine there's no countries
It isn't hard to do
Nothing to kill or die for
And no religion too.
পৃথিবী, আমরা তোমার সন্তান,
না চাহিতে তুমি করিয়াছ দান –
আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ,
সীমান্তহীন দেশ, কাল, স্থান,
অবাধ আমন্ত্রণ, অনায়াস অভিজ্ঞান ।
ঘুচে যাক দেশ-বিদেশের সীমারেখা, ব্যাবধান;
মানবোনা ভিসার আইন – তোমার অপমান।‘
‘সীমান্তহীন জগতে আর রইলো না আলাদা দেশ
এক হোলো ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশ।
কাছাকাছি থাকার জন্যে এক হোলো দুই বাংলা তাদের মাতৃভাষার খাতিরে,
হিন্দু-মুসলমান এক হোলো শুধু আমাদের সংসারে নয়, বাঙালীদের ঘরে ঘরে ।‘
********
ঠাকুর্দার গল্প শেষ। সবাই প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত। ইমরান জিগ্যেস ক’রলো,
‘ঠাকুমার সঙ্গে প্রথম দিনটির আছে কি কোনো memento বা স্মরণচিহ্ন?’
‘আলবৎ আছে’, ঠাকুর্দা বললেন ঠাকুমাকে, ‘দেখাও না একটু এদের’।
আলমারী খুলে ঠাকুমা বার করলো শাড়ী রাখার একটা বাক্স কাগজের;
প্রায় ডজন দুয়েক ন্যাপথলিনের বলের শুভ্র সমাহার –
তার নীচে ঠাকুমার দোপাট্টা, কামিজ আর সালোয়ার;
একটা একটা ক’রে তুলে দেখালেন ঠাকুমা, খুদা হাফিজ,
সালোয়ার, দোপাট্টা আর ফর্দাফাঁই ক’রে ছেঁড়া সে কামিজ;
ঠাকুর্দা বললেন, ‘এগুলো রাখা আছে না কেচে;
প্রথম দিনের স্মৃতির গায়ের গন্ধ রয়ে গেছে।‘
বললো ইমরান, ‘ঠাকুমা, দাঁড়াও এদিকে ফিরে,
মুখখানা তোমার দেখি একটু ভালো ক’রে।‘
ঠাকুমা বললেন, ‘দ্যাখো ভালো ক’রে নয়ন মেলে,
লুটে নিয়ে যেতে আমাকে এতদিন বাদে এলে?’
জিগ্যেস করলো ইমরান, ‘ঠাকুমা, সেই সময়ের ফটো আছে কোনো?’
ঠাকুমা তুলে দিল ইমরানের হাতে একটা ফটো সোনালীফ্রেমে বাঁধানো,
বললো, ‘এই ফটোটা আমাদের বিয়ের সময়ের;
বোঝা যায় না যে আমি অন্তঃসত্ত্বা চার-মাসের।‘
ঠাকুমার কথা হয়তো ইমরানের কানে গ্যালো না;
ইমরান আস্তে আস্তে বললো, ‘মে-হে-র-উ-ন্নি-সা’।
ঠাকুমা মন্ত্রমুগ্ধ, বললো, ‘এটা তো আমার নাম’।
‘ইউরেকা, পেয়েছি তোমায় খুঁজে’, বললো ইমরান,
‘আমাদের বাড়ীতে এই ছবি আছে;
সব সময় দাদা রাখেন তার কাছে
এখন উনি রিটায়ার্ড; দেখেন ছবিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে,
বলেন, ‘কেমন ক’রে যে মেহের গ্যালো হারিয়ে ।
রোজ ব’সে অপেক্ষা করেন বাড়ীর চাতালে –
হয়তো ফিরে আসবে মেহের কোনো সকালে।
২৯এর-বি-পদ্মপুকুর রোড মনে পড়ে, ঠাকুমা?’
‘পড়ে বৈকি; ওখান থেকেই লুটেছিলো ঠাকুরদা;
ইমরান! তোমার দাদা তো নিকে ক’রেছিলেন আবার,
নয়তো জন্ম হোতো না তোমার বা তোমার বাবার?’
‘তোমার ভাসুর, একটু আগে বলছিলেন ঝিকির ঠাকুরদা,
আগের বৌকে বাঁজা ব’লে ক’রতো নিয়মিত ঝাঁটাপেটা;
অথচ সেই বাঁজা-বৌ ক’রতো সংসারের সব কাজ।
একদিন আমার দাদা. অর্থাৎ তোমার মানুষ হাব্বাব,
সহ্য ক’রতে না পেরে এই অন্যায় নারী-অত্যাচার অবিচার
ওঁর বড়ে ভাইকে বললেন – তালাক দাও বৌকে তোমার।
যদি তোমার স্ত্রীর সম্মান না দিতে পারো ওকে,
থাকো নিয়ে খালি তোমার আদরের নতুন বৌকে ।
বড়ে ভাই তালাক দেবার পরে বেচারী ফতিমাকে,
দাদা হাব্বাব তাকে ক’রে নিল সসম্মানে নিকে;
নানী ফতিমা বাঁজা নয় কয়েকমাস পরেই তা দেখা গেল,
আমার আব্বাজান ওয়াসিম তার গর্ভে সন্তান হ’য়ে এল।‘
‘আমি খুব খুশী মনে, হাব্বাব ফতিমাকে ক’রে নিকে
ওয়াসিমের জন্ম দেওয়াতে’- ঠাকুমা বলে হাসিমুখে।
ঠাকুর্দার দিকে ফিরে ইমরান বললো এবার,
‘মাননীয় অর্জুন মহাশয়, করুন দোষ স্বীকার।
আপনি ও আপনার বিবাহিতা পত্নী সুভদ্রাঠাকুমা
প্রমাণের হদিশ দিয়ে ক’রেছেন অপরাধের বর্ণনা;
ম্যাজিস্ট্রেট আমি, দিতে পারি আপনাকে কারাদণ্ড যাবজ্জীবন;
অথবা আমার দাদা হাব্বাবকে দিতে পারি ঘটনার পূর্ণ বিবরণ।‘
ঠাকুর্দা বললেন, ‘মাথা পেতে নেবো যে দণ্ড সমীচীন করবে মনে
ম্যাজিস্ট্রেট ইমরান তুমি বা হাব্বাব সুভদ্রার স্বামী, তোমরা দুজনে;
কিন্তু ক্ষমা কোরো নিরাপরাধিনী সুভদ্রাকে
কোনো শাস্তি যেন পেতে না হয় তাকে’।
ঠাকুমা বললেন, ‘অর্জ্জুন, সমস্ত শাস্তি আমারই পাওনা;
লুটে আনার সময় তোমার একেবারেই ছিল না জানা -
বিবাহিতা আমি মুসলমানের বৌ - যখন গেল শোনা এই সত্যি দুটি,
তখন এক মুসলিম গৃহবধূর বাড়ী ফিরতে দেরী, এক অমার্জনীয় ত্রুটি;
গৃহবধূর মৃত্যুদণ্ডই যখন অনিবার্য্য বংশের সম্মানের খাতিরে;
তখন আশ্রয় চেয়েছি অর্জ্জুনের, ওকে বিবাহের অঙ্গীকারে;
বাড়ীর নিষেধ সত্ত্বেও অর্জ্জুন নিয়েছে আমাকে জীবনসঙ্গিনী ক’রে,
মিটিয়েছে দেশ-বিদেশের সীমারেখা, অদ্বিতীয়ত্ব মানবতার জোরে।‘
স্থির হ’য়ে নিরুত্তর হতবাক ইমরান, দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ,
ধাবিল তীরবেগে ঘরের বাহিরে, পুনরায় শান্ত হ’য়ে প্রত্যাবর্ত্তন।
আমরা সবাই সন্ত্রস্ত – কী ক’রবে ইমরান? ও চলেছে জানলার দিকে,
একটু একান্তে গিয়ে ওয়ালেট বের ক’রলো ইমরান ওর পকেট থেকে,
ওয়ালেটের পকেট থেকে একটা ফটো ক’রলো বার –
হাসিমুখদুটি দাদা হাব্বাব আর নানী মেহেরউন্নিসার ।
ফটোটি কপালে ঠেকিয়ে আদাব ক’রলো ইমরান,
বললো, ‘পেয়েছি যদিও অপরাধের নিখুঁত প্রমাণ,
অভিযুক্ত ক’রবোনা কাউকেই আপনাদের দুজনের;
অপরাধী ঐতিহ্য নিয়মধারা একালের ও সেকালের।
এক:- নিয়ম রয়েছে মেয়ে লুট ক’রে বিয়ে করার,
অথচ আইন নেই পকেট মেরে মানিব্যাগ নেওয়ার।
বেআইনী - কোনো জিনিস চুরি করা, কোনো ছেলেচুরি করার মতিভ্রম;
অথচ মেয়ে চুরি আইনসঙ্গত, কারণ মেয়ে লুটে ক’রে বিয়ে করা নিয়ম;
দুই:- নারীহত্যার নিয়ম বংশসম্মান বজায় রাখার খাতিরে,
শাস্তি দিতে হবে দুর্বৃত্তকে, রক্ষা করো প্রতারিতা নারীরে।
নারীহত্যা আর মানুষ-খুন অপরাধ একই পর্য্যায়ের,
ভেবোনা নারীকে সমান কুকুর বেড়াল জানোয়ারের।
যদি যথার্থভাবে বিধিবদ্ধ না থাকে এই দুই ব্যাপার,
ক’রতে হবে আমাকে সেই সব আইনের সংস্কার।’
‘সাবাস!’ বলে উঠলো ঠাকুর্দা, ঠাকুমা সমস্বরে;
সঙ্গে যোগ না দিয়ে আমিও উঠলাম না পেরে।
অশ্রুধারা দু-চোখ জুড়ে আমার, ধরলাম ইমরানকে জড়িয়ে;
একটু দূরে রইলো ঠাকুর্দা, ঠাকুমা অভিভূত হ’য়ে দাঁড়িয়ে।
হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, ঘটি নয়, বাঙাল নয় - মানুষ খাঁটি ভালবাসার,
চাই কেবল মানুষ, মনের মানুষ, প্রেম নয় কেবল পুরুষ বা মহিলার।
যায় কি পাওয়া মনের মানুষ লুট ক’রে?
ক্ষ্যাপার মতো পরশ পাথর খুঁজবে ফেরে,
যেখানে দেখবে ছাই, দেখো উড়িয়ে নেড়ে,
পেতেও পারো কোনো স্পর্শমণি রতনেরে।
–––––––––– সমাপ্ত ––––––––––
Click Follow to receive emails when this author adds content on Bublish
Comment on this Bubble
Your comment and a link to this bubble will also appear in your Facebook feed.