পরদিন সকালে চায়ের টেবিলে
আমিই বললাম সব কথা খুলে।
বললাম, ‘লুটতে গিয়ে কোনো কুমারী কন্যাকে,
না জেনে তুলে এনেছি আমি এক বিবাহিতাকে;
আরও বেশী মাত্রা মোর এ অপরাধের;
কারণ শুধু পরস্ত্রী নয় সুভদ্রা আমাদের,
গৃহবধূ সে এক জোয়ান মুসলিম মরদের।‘
হতবাক সবাই বাড়ীর; বিস্ফোরণ বারুদের,
মাথা নীচু নির্বাক নতুন বৌ সুভদ্রার,
আকুল অশ্রুধারায় ভাসে দুচোখ তার।
নিশপিশ করছিল মা, চড় মারবে গালে কার,
ঠিক করতে পারছিল না, আমার না সুভদ্রার।
বাবা স্তব্ধ – ঘৃণায়, রাগে; শুরু হবে নির্দয় শাসন.
পুত্রস্নেহ নিশ্চিহ্ন, ছারখার ক’রে দেবে ত্রিভুবন।
শান্ত স্পষ্ট গলায় শুরু ক’রলাম ধীরে ধীরে আবার,
‘সুভদ্রার ঠিকানার নেই আমাদের কোনো দরকার
না ওর শ্বশুরবাড়ীর, না ভাই বা বাপের বাড়ীর ওর।
শেষ ক’রে দেবে ওকে শ্বশুরবাড়ীতে খাইয়ে জহর;
ঘরপালানো বৌকে খুন বংশমর্য্যাদা বাঁচানোর জন্য,
এতো ওদের অবশ্য কর্ত্তব্য, এতে হবে পরম পুণ্য;
শক্তিশালী পুরুষের ধর্ম্ম বৌ-ঠেঙানোর ঐতিহ্য,
মেয়েদের পরপুরুষের সংসর্গ ক’রবে না সহ্য।
প্রথম স্ত্রী চার বছরেও পারেনি দিতে কোনো সন্তান,
নতুন বৌ এনে ওর ভাসুর শুরু ক’রেছে অনুসন্ধান।
বাঁজা বৌ খায় ঝাঁটাপেটা আর ছোট রাণী পায় যত আদর;
সংসারের সব কাজ করে বাঁজা-বৌ, পায় না যোগ্য কদর।
লুটে আনা সুভদ্রাকে ওখানে দিলে ফিরিয়ে,
বিছুটি দিয়ে মেরে নেবে ওর ছাল ছাড়িয়ে;
তারপর উৎসব ক’রবে ওকে খুন ক’রে, কেটে ফেলে।….
আলাদা ফল হবে না ওর বাপের বাড়ীতে খবর দিলে।
কারণ ওরা নিশ্চয় ওর শ্বশুড়বাড়ীতে খবর দেবে।
জানাজানি হ’লেই আমাদের উপরেও হানা হবে।‘
‘এই অবস্থায় আমি সুভদ্রাকে’, একটু থেমে বললাম আবার,
নেবো না ঝুঁকি ওর কোনো আত্মীয়ের বাড়ীতেই পাঠাবার ।
আমার দোষে তোমরা যদি তাড়াও সুভদ্রাকে,
চ’লে যাবো আমিও ওর সঙ্গে এ-বাড়ী থেকে।
শুরু ক’রবো নতুন জীবন নিয়ে কোথাও বাড়ীভাড়া,
কোনমতেই বাঁচবো না একা আর হ’য়ে সুভদ্রা-হারা।‘
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। বাবা বললেন, ‘এই নিয়ে আর
এখন চায়ের টেবিলে আলোচনার নেই কোনো দরকার,
সুভদ্রাকে করবেনা কেউ অহেতুক জেরা বা জিজ্ঞাসা ।
যে যার কাজে যাও, আলোচনা করো নিয়ে এই সমস্যা,
অন্য কারুর সঙ্গে এই পরিবারের ভিতরে;
এবাড়ীর গোপন খবর যেন না যায় বাইরে;
আমি পরে শুনবো পরামর্শ প্রত্যেকের।
কার কী করণীয় জানাবো তোমাদের।‘
********
সুভদ্রাকে নিয়ে কী করা হবে তাই নিয়ে মিটিং এই -
ডেকেছেন বাবা; সুভদ্রা বাদে হাজির বাড়ীর সবাই।
প্রথম প্রশ্ন ক’রলো আমাকে সর্বকনিষ্ঠ তুলি,
‘এক বাড়ীর বৌকে কেন লুটে নিয়ে এলি?
যতদূর জানি বেআইনী - কোনো বিবাহিতা মেয়ে লুট করা ।‘
আমি বললাম, ‘ওকে বিবাহিতা ব’লে একেবারে যায়নি ধরা,
কারণ কপালে ওর ছিল না সিঁদূরের ছোঁয়া;
ছিল না প’রে ও কোন বোরখা বা আবায়া ।
তবে আজকাল হচ্ছে অনেক বিয়ে,
জবরদখল ক’রে বিবাহিতা মেয়ে।
swimwear & lingerie manufacturer সমাজপতিদের দ্যাখো;
প্রতি ডিসেম্বরের গোড়াতে ওরা করে একটা এলাহি ফ্যাশন শো,
সেখানে প্রতিটি কর্ম্মচারীর স্ত্রীকে অংশ নিতেই হবে প্রতিযোগিতায়;
যে মহিলা জেতে বিজয়িনীর ট্রফি তার স্বামী ডবল প্রোমোশন পায়,
প্রোমোশনের মূল্য হিসেবে ছাড়তে হয় সুন্দরী জীবনসঙ্গিনীকে.
সমাজপতি পরিবার বধূ হিসেবে নেয় ফ্যাশন-শো-বিজয়িনীকে;
সে হয় খ্রীষ্টমাস গিফ্ট সমাজপতি পরিবারের কোন এক পুরুষের।
তবে ব্যবসায়ী বুদ্ধি বড়ই প্রখর বিজয়িনী মহিলাটির - গতবছরের;
সে এখন প্রথম মহিলা ম্যানেজিং ডাইরেক্টর কোম্পানীর;
বন্ধ ক’রে দিয়েছে প্রথা - কিনে নেওয়া কর্ম্মচারীদের স্ত্রীর।‘
মা বললেন, ‘ভেবে কি হবে, সমাজপতিরা কী করে না করে?
কেউ কিছু ব’লবে না, কারণ অঢেল পয়সা আছে ওদের ঘরে।
… তুই বলছিলি, সুভদ্রাকে যদি চলে যেতে হয় এবাড়ী ছেড়ে,
ও খেটে খাবে লোকের বাড়ীতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ ক’রে ।
ও করুক না কাজ আমাদের বাড়ীতেই; দেবো ভালো মাসোহারা;
ক’রবে বাড়ীর বাসনমাজা, ঘর ধোয়া, কাপড়কাচা আর রান্নাবাড়া।
যে তিনটে ঠিকে লোক আছে, তাদের দেবো ছাড়িয়ে,
ছশো টাকা বাঁচাবো মাসে নানা রকম ঝামেলা বাঁচিয়ে;
সুভদ্রা পাবে বিনা খরচে খাওয়া-পরা আর থাকা,
হাতখরচও দেবো না হয় প্রতি মাসে দুশো টাকা।‘
তুলি বললে, ‘বৌদি, সরি সুভদ্রা, আমার সেলাইবোনা,
ছবি আঁকার কাজেও হাত বাঁটাবে, ক’রবে আলোচনা ।‘
মিলি বললো, ‘ও আমাদের সঙ্গে খেলতে পারে ক্যারম।‘
মা বললেন, ‘তাস দাবাও খেলতে পারে; সঙ্গে চা গরম। ‘
বাবা বললেন, ‘এরকম পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা একটা মাল
কিছু-না-কিছু কাজে লাগবে সকলেরই, হবে নানা দেখভাল।
ইংরেজ কোনো সাহেবকে ডাকবো যখন বাড়ীতে
ওকে বলবো মুসলমানী বিরিয়ানী ক’রে খাওয়াতে;
ভালো খেয়ে সাহেবের হয়তো হবে বিছানাতে যাওয়ার মেজাজ;
তখন তামাক, মদ আর মেয়েমানুষ দিয়ে করতে হবে তোয়াজ।
বর্ত্তে যাবে সাহেব পেলে মুসলমানের সুন্দরী ফর্সা একটা বৌ;
আমার কপালে জুটবে তখন কোন ডবল প্রোমোশনের ফাউ ।‘
মা বললেন, ‘নিজেরও কাজে লাগবে তোমার;
খরচ বাঁচবে শনিবারে হাড়কাটা লেনে যাওয়ার’
বাবা বললেন, ‘ঠিক বলেছো, তুলির মা,
হাড়কাটা লেনে তেমন মাল আর পাইনা;
বহুদিন ধ’রে পুষেছি মনে একটা লোভ আমার,
বোরখা খুলে একটা তাজা গরম মোসলা চাখার।
এমন টাটকা জোয়ান মুসলমানী বৌ পেলে,
ঝাল ঝাল মুর্গমসল্লম বিরিয়ানী দেবো ফেলে।‘
আমি বললাম, ‘প্লীজ চুপ করো, যত অশ্লীল প্রলাপ থামাও;
মুসলমান হলেও মেয়েমানুষ ও, ওকে নারীর মর্য্যাদা দাও।
ওকে কাজ দেবার নেই আর কোনো প্রয়োজন;
বাড়ী ছেড়ে যাবো চলে যাবো শিগ্রি আমরা দুজন,
এই সপ্তাহের শেষে একটা বাড়ী ভাড়া ক’রে।
এখন চললুম স্ত্রী সুভদ্রার কাছে. আমার ঘরে।‘
********
কাজের ফাঁকে খোঁজ ক’রছিলুম, পরদিন ব’সে অফিসে,
দু-বেডরুমের ফ্ল্যাটের জন্যে মোটামুটি ভদ্র পরিবেশে;
বিনয় বসু রোডের দুটো ফ্ল্যাটে গেলাম দিনের শেষে
মোহিতকে সঙ্গে নিয়ে জরিপ করতে ওখানে এসে;
ঘরটা বেশ ভালো লাগলো; উত্তর আর পূর্ব্বদিকে
বারান্দা ও জানলা; সারদিন রোদ-হাওয়ার চমকে।
ফ্ল্যাটের মালিককে বললাম, ‘কাল স্ত্রীকে নিয়ে আসবো;
ওর যদি পছন্দ হয় এক মাসের অ্যাডভ্যান্স দিয়ে যাবো ।‘
********
বিনয় বসু রোডের ফ্ল্যাটের খবর দেওয়ার একটু সুযোগ
পেলুম না বাড়ীতে ফিরে; ব্যস্ত সবাই খুব; ভীষণ দুর্যোগ।
তুলি লুট হ’য়ে গেছে; বাড়ীর সবাই দিশেহারা,
চিন্তিত মুখে এদিক ওদিক ক’রছে ঘোরাফেরা।
কথা ছিল তুলির একটু দেরীতে ফেরার;
স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তীর রিহার্সালের ব্যাপার।
সন্ধ্যে ৬টা বেজে যাবার পরে হ’লো উদ্বেগ সবার,
মিলি গিয়ে দেখে, রিহার্সাল শেষ, স্কুল অন্ধকার।
‘আদরের মেয়ে লুট হ’য়ে গেলে আমাদের সমাজে
একটু ব’সে কাঁদার সময় নেই, বিকেলে বা সাঁঝে,
ডিনার রেডী করতে হবে, বাকী সব গিলবে রাত্তিরে।‘
এই বলে মা মনের দুঃখ চেপে ঢুকলো রান্না ঘরে।
কিছু শোনা গেলো না, কিছু গেলো –
মা গজগজ ক’রে কি যেন বললো,
‘এত বয়স হোলো বড় মেয়ে মিলিটার,
যেমন চাপা রঙ তেমনই গড়ন তার;
মার্শ্যাল আর্টে ব্ল্যাকবেল্ট সবলা আমার মেয়ে,
কোন্ পুরুষই বা ঘেঁষবে কাছে দুঃসাহস নিয়ে;
পি-এইচ-ডি ক’রছে এম-এস-সি করার পরে;
আছে কোন গুনী বলবান যে ওকে লুট করে ।‘
রাত্রে ডিনারের পর বাবা একান্তে ডেকে বললেন আমাকে,
‘কালকে মিটিঙে যা বলেছিলুম তা বলিসনিতো সুভদ্রাকে?
আমি ভেবে উঠতে পারিনি যে তুই সুভদ্রারে
নিজের স্ত্রীর মতো নিয়েছিস আপন ক’রে।
আমি ভেবেছিলাম, তুই ওকে নিয়ে এসেছিস লুটে,
ভাল মালটা নিয়ে মজা করবি, খাবি চেটে পুটে।
যাই হোক, তুলি হয়তো আসবে না আর ফিরে;
সুভদ্রাকে বল আজ থেকে যেন শোয় তুলির ঘরে।
পরুক ও তুলির জুতো-জামাকাপড়, যা কিছু উপকরণ;
যতদিন না বিয়ে হচ্ছে, আলাদা ঘরে শো তোরা দুজন।‘
********
সুভদ্রা জানালো অর্জ্জুনকে মে মাসের শেষ দিকে -
ওর পিরিয়ড হয়নি - এবাড়ীতে আসার পর থেকে ।
ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো অর্জ্জুন দেরী না ক’রে।
জানা গেল সুভদ্রার গর্ভে সন্তান গত তিন মাস ধ’রে,
অর্থাৎ দেড় মাসের পোয়াতীকে লুটে এনেছে অর্জ্জুন;
চুপসে গ্যালো অকস্মাৎ অর্জ্জুনের পিতৃগর্ব্বের বেলুন।
নিরাশ অর্জ্জুন চাইলো গর্ভবতী সুভদ্রার অনুমতি,
ক’রে গর্ভপাত মিটে যাক অতীতের বিস্বাদ স্মৃতি।
জীবনের ধন সুভদ্রা ক’রবেনা অপচয়; ক’রলো অনুনয়,
‘ভ্রূণের বয়স নিয়ে আর কারো সাথে যেন কথা না হয় ।‘
********
অনেক ভেবে কেয়াকে তার বাবা বোঝালো মাসখানেক বাদে,
‘শ্যামলকে বিয়ে না করলে, হয়তো কিছুই জুটবে না বরাতে।
পাড়ার ছেলেরা কোনোমতেই আর কেয়ার দিকে দেবে না নজর,
কারণ, ওরা হয়তো জেনে গেছে ওর একবার লুট হওয়ার খবর।
বেপাড়ার কোনো মরদ এসে যদি কেয়াকে নিয়ে যায় লুটে,
হবেনা শ্যামলের মতো কেউ, হয়তো হবে, কুলি কিংবা মুটে।‘
কেয়ার বাবার অনুরোধে রাজী হলেন শ্যামলের বাবা অনায়াসে;
সেই সঙ্গে রাজী হ’লেন সুভদ্রার বাবা হ’তে, ওকে ভালোবেসে।
ঠিক হোলো ১৬ - ১৭ই জুলাই বিয়ে হবে সুভদ্রার-আমার
আর ঐ দুদিনেই মালাবদল হবে শ্যামলের সঙ্গে কেয়ার।
********
একদিন লাঞ্চের সময় ডালহৌসীতে করছি আনাগোণা;
কেউ ডাকলো ‘দাদা’ বলে, গলার স্বর বহুবার শোনা;
মুখ তুলে দেখি, কাছে দুটি বোরখা পরা মেয়ে,
এগোলাম ওদের দিকে, সসংকোচে ভয়ে ভয়ে।
তখন ওদের মধ্যে একজন তুললো মুখের চাপা;
হাসিমুখে বললো সে, ‘চিনতে পারছিস না, দাদা?’
‘তুলি তুই?’ বলে এগিয়ে গেলুম;
তুলি অনেক কাঁদলো মাথা রেখে আমার বুকে;
’১৬ আর ১৭ই জুলাই প্লীজ
আসিস আমাদের বিয়ে দেখতে’ বললুম ওকে।
তুলি বললো, ‘না দাদা, আমাকে খুব যত্ন করে ওরা;
কিন্তু হুকুম নেই; হবেনা তোমাদের সঙ্গে দেখা করা।’
ডালহৌসীতে ঘুরি রোজ লাঞ্চের সময় এরপর থেকে;
বারবার ক’রে দেখি প্রতিটি বোরখা-পরিহিতার দিকে,
কিন্তু হতাশ আমি, শুনিনি তুলির ‘দাদা’ ডাক আর;
তুলি কেমন আছে এখন? বৃথাই ঘুরি রোজ বারবার।
********
Click Follow to receive emails when this author adds content on Bublish
Comment on this Bubble
Your comment and a link to this bubble will also appear in your Facebook feed.